জান্নাতুল ফেরদৌস, বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোর
২৪ অক্টোবর ২০২২ ০৪:৫৩
প্রতীকী ছবি
মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ছে; বাড়ছে নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতাও। ফলে আবহমানকাল ধরে চলে আসা একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে রূপ নিচ্ছে একক পরিবারে। অনেক সময় একক পরিবারও আর থাকছে না। জীবিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে চার জায়গায় থাকতে হচ্ছে চার সদস্যের একটা পরিবারকেও। এতে করে শিথিল হচ্ছে বন্ধন; বদলাচ্ছে মানুষের মূল্যবোধ। পরিবার ভেঙে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকেই দূষছেন পুঁজিবাদি সমাজব্যবস্থাকে, আবার অনেকে বলছেন ব্যক্তিগত আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতার কারণেই মূলত মানুষ তার শিকড় থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশে বিচ্ছিন্নতার হার বাড়ছে, নগরায়নের কারণে মানুষের মূল্যবোধেও অনেক পরিবর্তন এসেছে।
কেন পরিবার গুরুত্বপূর্ণ
পারিবারিক সম্পর্ক মানসিক স্বাস্থ্য, আচরণ, এমনকি শারীরিক স্বাস্থ্যকেও উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক সম্পর্ক, বিশেষ করে পারিবারিক সম্পর্ক একজনের মানসিক স্বাস্থ্যে দীর্ঘ কিংবা স্বল্পমেয়াদে প্রভাব ফেলতে পারে। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে শিশুদের নিয়ে একটি পদ্ধতিগত পর্যালোচনা করা হয়। তাতে ১৩ থেকে ২২ শতাংশ শিশুর মধ্যে মানসিক রোগের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিবারের সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া কোনো মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশ সম্ভব নয়। মূল্যবোধ, আনুগত্য, অন্যের অধিকার ও মতামতকে সম্মান জানানো কিংবা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মতো বিষয়গুলো মানুষ পরিবার থেকেই শেখে।
পরিবার ও মানসিক স্বাস্থ্য
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যে পরিবার কতটা প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ে একটি গবেষণা করেছেন মার্কিন মনোবিজ্ঞানীরা। তাদের গবেষণা প্রতিবেদনটি ছাপা হয় ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব সাইকোলজিক্যাল মেডিসিন’ সাময়িকীতে। এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে মাত্র ১১ শতাংশ শিশু তার ‘বায়োলজিক্যাল’ মা-বাবার সঙ্গে থাকেন। বাকি ৮৯ শতাংশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কেউ শুধু মায়ের সঙ্গে থাকেন, কেউ থাকেন শুধু বাবার কাছে। সৎ মা-বাবার কাছে থেকেও বেড়ে উঠছেন অনেকে। গবেষকরা দেখেছেন, বায়োলজিক্যাল মা-বাবার কাছে থাকা শিশুদের মধ্যে ৩৬ শতাংশ বিষন্নতায় ভোগেন। অন্যদিকে যারা বায়োলজিক্যাল মা-বাবার সঙ্গে থাকেন না, তাদের মধ্যে বিষণ্নতার হার ৭১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরমিখ পরিবার সম্পর্কে বলেন, ‘পরিবার হচ্ছে একটি মানবিক সংগঠন, যেখানে মানুষ তার প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব বেঙ্গলনিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, ‘যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবার গঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া একটি স্বাভাবিক বিষয়, যা নগরায়নের ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘটছে এবং মানুষ অর্থনৈতিক প্রয়োজনেই আলাদা বসবাস করছে। আর এর প্রভাবে পরিবার ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আর যৌথ ও একক পরিবার উভয়েরই সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। অসুবিধা বলতে যেমন, আগে যৌথ পরিবারে অভিভাবকের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি, যাদের সবাই পরিবারের অন্য সদস্যদের সব বিষয়েই হস্তক্ষেপ করত; অতিরিক্ত শাসন ও খবরদারি করত। পরিবারের সদস্যদের স্বাধীনতা কম ছিল। একসঙ্গে থাকার জন্য ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টাও তেমন ছিল না। এখন সুবিধা হলো, কেউ কাউকে পাত্তা দেয় না। তাই যার যা ইচ্ছা, তাই করতে পারছেন, যেভাবে খুশি সেভাবে থাকছেন। ফলে পারিবারিক টানাপোড়নগুলো কমে গেছে। মানুষ ব্যক্তিগত জায়গা থেকে স্বাধীন চিন্তা করতে পারছে। পরিবার ক্ষুদ্র হয়ে যাওয়ার প্রভাব স্বাভাবিকভাবে দেশের অর্থনীতির ওপরও পড়ছে। অর্থনৈতিক কারণেই মূলত মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’
শিশুদের ওপর পরিবারের প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে এই মনোবিজ্ঞানী বলেন, ‘ব্রোকেন ফ্যামিলি অর্থাৎ বিচ্ছেদের (ডিভোর্স) পর শিশুদের ওপর সামাজিক ও পারিবারিক, দুই ধরনের প্রভাবই পড়তে পারে। সামাজিক প্রভাব বলতে শিশুরা সমাজের মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হয়। তাদের মা-বাবাকে নিয়ে নানা নেতিবাচক কথাবার্তা বলা হয়। আর পারিবারিক প্রভাব বলতে শিশুরা একা হয়ে যায়; হঠাৎ করে তারা তাদের মা-বাবাকে আলাদা থাকতে দেখে। মা-বাবাকে একসঙ্গে না পাওয়ার কারণে তাদের মানসিকতার উপর প্রভাব ফেলে।’
জেডএস/এএল